RED STONE
Leatest stories:

বুধবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৬

কান্তার মরু (পর্ব -১)

০১:
বিসিআই হেডকোয়ার্টার, মতিঝিল, ঢাকা।
‘এটা একটা খাপছাড়া ব্লাইণ্ড মিশন, রানা, পুরোপুরি অফিশিয়ালও বলা যায় না।’ চুরুটে অগিড়বসংযোগ করে বললেন রাহাত খান। সুপরিসর কামরায় বিশাল ডেস্কটার পেছনে বসে তিনি। দপদপ করে লাফাচ্ছে কপালের শিরা। ‘খবর পেয়েছি, মোট তেইশটা মিসাইল আর নিউক্লিয়ার ওঅরহেড চুরি গেছে। ইথিওপিয়ায় রয়েছে এখন সেগুলো।’
‘মিসাইলগুলো কাদের, স্যার?’
‘এক কথায় বলতে গেলে সবার। আমেরিকা, রাশিয়া, মিশর, ইসরাইল, সিরিয়া এমনকি সবচেয়ে মারাত্মক কথা, এ দেশগুলো একে অন্যকে সন্দেহ করছে। আমেরিকা মনে করছে রাশিয়া কিংবা লিবিয়া তার মিসাইল চুরি করেছে, রাশিয়া মনে করছে আমেরিকা। ইসরাইল মনে করছে মিশর আর মিশর ভাবছে ইসরাইল। ইরাক সন্দেহ করছে আমেরিকাকে।
‘মিশর ছোট থেকে মাঝারি পাল্লার পাঁচটা মিসাইল খুইয়েছে। ইসরাইল থেকে চুরি গেছে এমনি আরও ছ’টা। আমরা জানি, এরা কেউই কারও জিনিস চুরি করেনি, অথচ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে এদের দেরি হবে না। এবং খুব শিগ্‌গিরিই ঘটবে সেটা।’
‘স্যার, চুরিটা কারা করল?’ রানা বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
‘মালদিনি। রবার্তো মালদিনি। দুর্দান্ত প্রকৃতির এক অর্ধোন্মাদ। বহুদিন ধরে ওর ওপর নজর রাখছি আমরা। মিসাইলগুলো এখন ওর হাতে আছে। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরেক নিও-ফ্যাসিস্ট – ব্রুনো কন্টি। ম্যাকলিন নামে নিজেকে পরিচয় দেয় সে ইদানীং। দুজনই ড্রাগের সঙ্গেও জড়িত। সরাসরি কিনা জানি না, তবে উৎপাদন করছে ওরা কোথাও, এটা প্রায় নিশ্চিত। অনেক দেশে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু সাবধান করার পরও কেউ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। অথচ আমি ব্যাপারটাকে মোটেই হালকাভাবে নিতে পারছি না, রানা। মালদিনি সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। তোমাকে ডেকেছি লোচনার
জন্যে। কী মনে হয় তোমার? বাজে চিন্তায় সময় নষ্ট করছি?’
‘জ্বী, স্যার,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল রানা। লক্ষ করল গম্ভীর হয়ে উঠেছে রাহাত খানের মুখের চেহারা। চট্‌ করে বলল, ‘আপনার যখন সন্দেহ হয়েছে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা দরকার। তাছাড়া, মালদিনির কিছু কিছু খোঁজ-খবর রানা এজেন্সির মাধ্যমেও জানা গেছে। আমরা জানি ওর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।’
‘এবার তাহলে বলা যায়,’ নড়েচড়ে বসলেন রাহাত খান। আশ্বস্ত দেখাল বুড়োকে। রানা ভাবল বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নরম হয়ে যাচ্ছে নাকি বুড়ো! ‘আগে বুঝতে হবে ওর উদ্দেশ্যটা কি। বুঝতে হলে কাউকে না কাউকে যেতে হবে ব্লাইণ্ড মিশনে। তোমার কথাটাই সবার আগে মনে পড়ল আমার। বেশ কিছুদিন আফ্রিকায় ছুটি কাটিয়েছ তুমি। কাজেই ওখানকার পরিবেশ তোমার ভাল জানা থাকার কথা। যাই হোক,’ চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন বৃদ্ধ।
‘ও যদি জানান না দিয়ে বিভিনড়ব দেশে মিসাইল ছুঁড়তে থাকে কি ঘটবে বুঝতেই পারছ। এক দেশ ঝাঁপিয়ে পড়বে আরেক দেশের ওপর। কাজেই যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে ওকে।’
ডেস্ক থেকে ‘টপ সিক্রেট’ লেখা একটা ফোল্ডার তুলে নিলেন বৃদ্ধ। পেপারগুলোয় চোখ বুলিয়ে বলতে ‘শুরু করলেন, ‘সত্তর দশকের শেষভাগে নিও-ফ্যাসিস্ট হিসেবে ইতালিতে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল রবার্তো মালদিনি। রাজনীতি ও সংগঠন নিয়ে যতদিন ব্যস্ত ছিল তার ব্যাপারে কারও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু পরে সে সহিংসতার পথ বেছে নেয়। ইতালিয়ান পুলিস তাকে গ্রেপ্তার করার আগেই লিভর্নো থেকে দেশান্তরী হয় সে।
‘আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে একেবারে নিখোঁজ হয়ে যায় লোকটা।’
‘স্যার, চাইনিজরা বা অন্য কোন দেশ, যেমন উত্তর কোরিয়া, ওর সাথে জড়িত নয় তো? ওদের তো মিসাইল খোয়া যায়নি।’
‘এক কথায় না বলা যাচ্ছে না, কিন্তু আমার অন্তত ধারণা-মালদিনি একাই করছে এসব।’ চুরুটের ধোঁয়ায় বুকটা ভরে নিলেন বৃদ্ধ।
‘ইথিওপিয়ার কোথায় রয়েছে ও?’
‘ডানাকিলে, জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স খোঁজ বের করতে পেরেছিল ওর। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দু’মাস আগে ওদের এজেন্ট স্রেফ উধাও হয়ে যায়।’
‘ডানাকিল, সে তো মরুভূমি, স্যার।’
‘ঠিক। সাইনাইয়ের মত ওটাও একটা ওয়েইস্টল্যান্ড, রানা। ইথিওপিয়ানদের ওটার ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আর মালদিনি যে ওখানে ঘাঁটি গেড়েছে একথা ওরা বিশ্বাসই করতে চাইছে না। সে যাকগে, ডানাকিলের বাসিন্দারা অচেনা লোক দেখলে খুন করতে দ্বিধা করে না। ইথিওপিয়ার মানচিত্রে রয়েছে জায়গাটা, কিন্তু আমহারিক উপজাতি, যারা এখন ক্ষমতায়, ওটাকে সভ্য করে তোলার কোন উদ্যোগ আপাতত নিচ্ছে না। বড় বিশ্রী জায়গা, রানা।
‘এখন তুমি কি বল, রানা? ইথিওপিয়ায় যাবে একবার? দেখবে পরিস্থিতি আদতে কতখানি ঘোলাটে?’
‘যাব, স্যার।’
‘এক বাঙালী বিজ্ঞানী আছে মালদিনির সাথে; আমার সঙ্গে অনেক দিনের পরিচয়,’ বললেন রাহাত খান। ‘কুদরত চৌধুরী। বর্তমানে ড্রাগ অ্যাডিক্ট। ডানাকিলে যাবার পর তাকে অ্যাডিক্ট হতে বাধ্য করেছে মালদিনি। আমাকে অনেক ইনফর্মেশন যুগিয়েছে সে। তুমি গেলে তার সাহায্য পাবে।’ ফাইলটা সামনের দিকে ঠেলে দিলেন বৃদ্ধ। অর্থাৎ যেতে পারো তুমি এবার। যতটা নরম ভাবছিল ততটা বুড়ো এখনও হয়নি বুড়ো, পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা।
পরবর্তী সপ্তাহে ডানাকিল সম্পর্কে পড়াশোনা করে যা জানল তাতে মোটেও আশ্বস্ত হতে পারল না রানা। এমনকি ওর যে পরিচয় খাড়া করা হলো, সেটাও ওর মনে ধরল না। আমেরিকা অভিবাসী এক বাঙালী মুসলমান সে। নাম আলী আকবর। এই পাবলিক ওঅর্কস এঞ্জিনিয়ারটিকে মার্কিন মুল্লুকের প্রতিটি সাবডিভিশন কালো তালিকাভুক্ত করেছে। দোষ কি তার? না, সে বেচারা ওখানে গিয়েও বাঙালীয়ানা ছাড়তে পারেনি। কন্ট্রাকটরদের কাছ থেকে দেদার ঘুষ খাওয়ার বদনাম রয়েছে লোকটার।
নরওয়েজিয়ান এক ফ্রেইটারে এখন সীট বুক করেছে সে। গন্তব্য মাসাওয়া। রাস্তা নির্মাণ করতে পারে এমন লোকের দরকার পড়েছে ইথিওপিয়ায়। কাজেই ঠিক হলো ওয়াশিংটন হয়ে মাসাওয়া যাচ্ছে মাসুদ রানা।

এয়ারপোর্টে ডাফ্‌ল্‌ ব্যাগ ও গোপন কম্পার্টমেন্টসমৃদ্ধ তোবড়ানো সুটকেসটা খুঁজে নিল রানা। গোপন কুঠুরীতে স্থান পেয়েছে প্রচুর গোলা-গুলি ও চমৎকার এক ট্র্যান্সিভার। এবার ট্যাক্সি ডাকল। রানার সস্তাদরের গুডউইল সুটটা এক নজর দেখে নিল ড্রাইভার।
‘বারো ডলার হবে তোমার কাছে?’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘কিন্তু মিটারটা ইউজ করো। নইলে প্রথমে আধমরা করব তারপর অভিযোগ দায়ের করব, বোঝা গেছে?’
রানার দিকে দ্বিতীয়বার দৃষ্টিক্ষেপ করল লোকটা। আলী আকবরের ছদ্মবেশ ছেড়ে বোধহয় বেরিয়ে আসতে চাইছে মাসুদ রানা, তবে তর্কাতর্কি করতে গেল না ড্রাইভার, নৌ-কাস্টমসে নামিয়ে দিল। বিনা বাধায় কাস্টমস্‌ পার হতে পারল ও। একজন ট্রাক ড্রাইভার ওকে পৌঁছে দিল ‘শেপ মাইয়ার’ জাহাজে।
কোঁকড়া, কালোচুলো স্টুয়ার্ড, ববি মুর, রানাকে দেখে খুব একটা খুশি হয়েছে মনে হলো না। হয়তো একটা কারণ, রাত দুটো বাজে এখন, আর নয়তো ওর বেশভূষা। কেবিনটা দেখিয়ে দেয়ায় লোকটাকে বখশিস দিল ও।
‘ওয়ার্ডরূমে সাতটা থেকে নটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট পাবেন,’বলল লোকটা। ‘মই দিয়ে নেমে এক নম্বর ডেকে।’
‘হেড কোথায়?’
‘প্যাসেঞ্জার কেবিনগুলোর সামনেই। শাওয়ারও পাবেন। দেখবেন, ভদ্রমহিলাদের ভয় পাইয়ে দেবেন না যেন।’
লোকটা চলে গেলে কোট খুলে সুটকেসে অস্ত্রগুলো চালান করল রানা, তারপর দরজা বন্ধ করে খুদে কেবিনটা পরখ করে নিল। মেইনডেকমুখী এক পোর্টহোলের পাশে সিঙ্গল বাঙ্ক। মেইন ডেকটার অবস্থান পোর্ট সাইডে। ডকটাও ওদিকে। দেখা গেল পাতলা পর্দা উজ্জ্বল আলোর প্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। ফরোয়ার্ড বাল্কহেডে রয়েছে সিঙ্ক। সঙ্গে লাগোয়া কম্বিনেশন ক্লজিট ও চেস্ট অভ ড্রয়ার্স। সকালে মালপত্র খুলে সাজাবে সিদ্ধান্ত নিল রানা। বিসিআই জানিয়েছে প্যাসেঞ্জার লিস্ট আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ। তবে সময়াভাবে সেভাবে নাকি খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। সাবধান থাকতে বলা হয়েছে ওকে।
সাবধান থাকতে বলা হয়েছে ভাল কথা, ভাবল রানা, কিন্তু কি থেকে কিংবা কার কাছ থেকে? বাতি নিভিয়ে বুকে হেঁটে বাঙ্কে উঠে পড়ল রানা। ঘুমটা মোটেও ভাল হলো না ওর।

০২,
যে কোন জাহাজ সাগরে ভাসানো এক ঝকমারি, কিন্তু শেপ মাইয়ার-এর ক্রুরা যেন পণ করেছে হুল্লোড় করে যাত্রীদের জ্বালিয়ে মারবে। হাতঘড়িতে নজর বুলাল রানা। সাতটা। সিদ্ধান্ত নিতে হয় এখন। স্টিলেটো সঙ্গে নেবে? আলী আকবরের কাছে ছুরি থাকলে মানাবে? মনস্থির করতে পারল না। সুটকেসের গোপন কম্পার্টমেন্টে শেষতক লুগার ও খুদে গ্যাস বোমাটাকে সঙ্গ দিতে রয়ে গেল ওটা। আজ সকালে ঘুমকাতুরে এক স্টুয়ার্ড নয়, অনেক মানুষের কৌতূহলী চোখের সামনে পড়তে হবে ওকে।
রানা সামনে গিয়ে, হেড ব্যবহার করে, শাওয়ার নিল। তারপর কেবিনে ফিরে এসে কাপড় বাছাই করল। শেপ মাইয়ারে ফর্মালিটির কোন প্রয়োজন নেই। ফ্লানেল শার্ট, ওঅর্ক প্যান্ট আর ওয়াটারপ্রূফ জ্যাকেট গায়ে চড়াল রানা। এবার ব্রেকফাস্টের পালা।
ছিমছাম এক ওয়ার্ডরূম। দশ জনের মত বসার আয়োজন, তারমানে জাহাজে যাত্রী বেশি নেই। স্টুয়ার্ড ববি মুর রানাকে জুস, স্ক্র্যাম্বল্‌ড্‌ এগ, বীফ ও কফি পরিবেশন করল। ওর খাওয়া প্রায় সারা এসময় বয়স্ক দম্পতিটি ঘরে প্রবেশ করলেন।
ইংরেজ এঁরা-জ্যাক ও ডেবি চার্লটন। ভদ্রলোকের একহারা গড়ন ও ফ্যাকাসে গায়ের রং দেখে কেরানী মনে হয়, এবং ছিলেনও নাকি তাই, লটারিতে বাজি মেরে দিয়ে এবং তারপর বুদ্ধি করে টাকাটা খাটিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। ভদ্রমহিলার মোটাসোটা গিনড়বী-বানিড়ব চেহারা। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই পঞ্চাশের কোঠায়, হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়াতে ভ্রমণ পিপাসু হয়ে উঠেছেন। এবং দু’জনেই বাক্যবাগীশ।
‘আপনি নরফোকের লোক, মিস্টার আকবর?’ জ্যাক প্রশ্ন করলেন।
‘না,’ বলল রানা। ‘বাংলাদেশী। ওপি ওয়ানে আমেরিকা এসেছি।’
‘ও, তাই নাকি,’ সুর তুললেন মিসেস চার্লটন। ‘আপনাদের বাংলাদেশ সরকার কিন্তু ট্যুরিজমে মোটেও মনোযোগী নয়। দু’বছর আগে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম আমরা। কক্সবাজার, সুন্দরবন এসব জায়গা খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার প্রশংসা করতে পারছি না, দুঃখিত, আর…’
ভদ্রমহিলার বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত হওয়ার জন্যে রানাও খানিকটা দায়ী। আলী আকবর হিসেবে ওকে শুনে যেতে হবে, কিন্তু মাঝেমধ্যে হুঁ, হাঁ করা ছাড়া কথোপকথনে ওর আর কোন অংশগ্রহণ থাকবে না। আলী আকবর প্যাচাল শুনবে তার কারণ বড়লোক সহযাত্রীদের কাছ থেকে ড্রিঙ্ক খসানোর তালে থাকবে সে। এবং সম্ভব হলে ডলারও।
অবশেষে, অবশ্যম্ভাবী সেই প্রশ্নটা করলেন মিসেস। ‘এই জাহাজে কেন উঠেছেন, মিস্টার আকবর?’
‘ইথিওপিয়া যাচ্ছি।’
‘কেন জানতে পারি?’
‘কাজে। আমি একজন এঞ্জিনিয়ার। রাস্তা-ঘাট, ড্রেনেজ সিস্টেম এসব তৈরি করি।’
‘বাহ, খুব ইন্টারেস্টিং কাজ মনে হচ্ছে?’
‘ডাল-ভাত জুটে যায় আরকি।’
রোডবিল্ডিং সম্বন্ধে বিশেষ জানার কথা নয় কেরানীর কিংবা গৃহবধূর, কাজেই চার্লটনদেরকে নিজ পরিচয় যা দিচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা নেই রানার। ও প্লেনে করে আদ্দিস আবাবা যেতে চেয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ আমেরিকার বোমা চুরির খবর পেয়ে মত পাল্টেছেন জেনারেল। এই জাহাজে উঠতে বলেছেন রানাকে। তাছাড়া রানার কভারের সঙ্গে নাকি চমৎকার খাপ খেয়ে যায় এই সুলভ ভ্রমণ। মিসেস চার্লটনের জেরা ও একতরফা বকবকানি মার খেয়ে গেল ওয়ার্ডরূমে ফ্রেইটারের আরেক যাত্রী প্রবেশ করতে। দরজা দিয়ে যুবতীটি ঢুকতেই রানার মনের ক্যাবিনেটে ফাইল কার্ড ওল্টানো শুরু হয়ে গেল। লম্বা, কুচকুচে কালো চুল, অপূর্ব সুন্দর দেহবল্লরী, আকর্ষণীয় মুখশ্রী — কোথায় দেখেছে একে রানা?
‘আমি জেন এসেক্স,’ বলল মেয়েটি। পরিচয় দিতেই রানা
চিনে ফেলল ওকে। সিআইয়ের এজেন্ট। এ-ই সম্ভবত ব্রিফ করবে ওকে।
চার্লটন দম্পতি নিজেদের পরিচয় দিলেন। রানার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেয়েটির হাত ঝাঁকিয়ে দিল ও।
মুখের অর্গল খুলে দিলেন আবারও মিসেস চার্লটন। বিনীতভাবে শুনে গেল জেন, কিন্তু রানা নিশ্চিত ওর মত সে-ও এর কিছুই মনে রাখবে না। এবার ভদ্রমহিলার তদন্তের পালা।
‘কি কর তুমি?’ প্র ম প্রশ্ন মিসেস চার্লটনের।
‘আমি ফ্রীল্যান্স জার্নালিস্ট।’
‘বাহ, উইমেন্স লিবে বিশ্বাস কর বুঝি?’ মিস্টার চার্লটন।
‘করি। তবে সাংবাদিকতা করি নিছক অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে।’ রানার দিকে চাইল যুবতী।
‘আপনাকে চেনা চেনা লাগছে, মিস এসেক্স,’ বলল রানা। ‘আমি যদিও পত্রিকা-টত্রিকা পড়ি না তেমন একটা।’
‘পুরুষদের ম্যাগাজিন তো পড়েন, তাই না, মিস্টার আকবর?’ বলল মেয়েটি।
‘তা পড়ি।’
‘তাহলে ওখানেই দেখেছেন। এডিটরদের ধারণা, একা একা কোন্‌ মেয়ে কোথায় কি অ্যাডভেঞ্চার করল খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে পুরুষরা। পিক্স সহ বেশ কয়েকটা স্টোরি ছাপা হয়েছে আমার। তাই মনে হয় চেনা চেনা লাগছে।’
‘তাই হবে,’ বলল রানা।
‘পিক্স?’ মিসেস চার্লটন শুধালেন। ‘পিকচার, মানে ছবি?’
‘শিয়োর। এই যেমন ধরুন-প্রতিনিধি রিওতোলন করছে। ব্যাঙ্ককের পাতায়া বীচে নগড়ব হয়ে গায়ে রোদ মাখছে। এইসব আর কি।’
মেয়েটির সম্পূর্ণ ডোশিয়ে মুখস্থ রানার। সিআইএ কখনোই নিশ্চিত হতে পারেনি জেন এসেক্স এজেন্ট হিসেবে কোন্ মানের-ভাল না মন্দ। ওকে সামনাসামনি দেখে বিভ্রান্তির কারণটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে রানা। চার্লটন দম্পতি, বলাবাহুল্য, মনে রাখবেন ওকে, চোখ-মুখ লাল করে এইমাত্র ওয়ার্ডরূম ত্যাগ করলেন তাঁরা। কিন্তু মেয়েটি এ-ও নিশ্চিত করল ওকে আর বিরক্ত করবেন না স্বামী-স্ত্রী। চালটা চেলে চালাকির পরিচয় দিয়ে থাকতে পারে জেন, কিংবা বোকামিরও। রানা বুঝতে পারল না কোন্‌টা।
‘আপনাকে নিয়ে হয়তো একটা স্টোরি করা যায়, মিস্টার আকবর,’ বলল জেন। ‘আপনি এই ফ্রেইটারে কেন?’
সেই রাস্তা-ঘাট বানানর গপ্পো ফাঁদতে হলো রানাকে।
‘গেলেই কাজে জয়েন করতে পারবেন?’
‘হ্যাঁ। মাসাওয়ার জেটিতে লোক থাকবে আমার জন্যে।’
‘বাজে দেশ, ইথিওপিয়া-দেখবেন চাকরি না খেয়ে দেয়।’
‘সাবধান থাকব আমি।’
আর যাদের চোখেই দিক না কেন, পরস্পরের চোখে ধুলো দিতে পারেনি ওরা। কিন্তু সবার সামনে মুখ খুলতে আপাতত রাজি নয় কেউ। কাজেই ওয়ার্ডরূম থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজের ছোট্ট লাইব্রেরীটায় গেল রানা। গোটা দুই পেপারব্যাক বাছাই করে ফিরে এল কেবিনে।

জ্যাক চার্লটনের সঙ্গে প্র ম দু সন্ধে দাবা খেলে কাটানর চেষ্টা করল রানা। একটা করে নৌকা আর গজ দান করে প্রায় পঁয়ত্রিশ চাল পর্যন্ত খেলাটাকে টেনে নিয়ে গেল, তারপর নির্বোধের মত মাত হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। সুতরাং দাবা ছেড়ে এরপর ব্রিজ ধরতে হলো। চরিত্র বিশে−ষণে আসলে সময়টা কাজে লাগাল রানা। চার্লটন দম্পতি নিপাট ভালমানুষ উপলব্ধি করছে ও, দুনিয়া ঘুরে বেড়াবে তারপর গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসে, প্রতিবেশীদের তাক লাগিয়ে দেবে। ওদিকে ধাঁধা হয়েই রইল জেন। তাস খেলায় রানার জুটি হয় সে, কখনও আমীর রানার আবার কখনও ফকির রানার।
যাত্রার তৃতীয় দিন সকালে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উত্তাপের আঁচ পাওয়া গেল। ওয়ার্ডরূমের চার্ট জানাচ্ছে, উইন্ডওয়ার্ড চ্যানেলে রয়েছে ওরা। স্পীড রেকর্ড সেট করেনি শেপ মাইয়ার। এ মুহূর্তে, কিউবার ঘন নীল পানির বুক চিরে, ঈষৎ টলমল করতে করতে এগিয়ে চলেছে জাহাজ। সেদিন সন্ধের দিকে জর্জটাউন পৌঁছানর কথা ওদের। সাতটার আগে বাঙ্ক ছেড়ে নাস্তা সারতে ওয়ার্ডরূমে গেল রানা। রাতে ঘুম ভাল হয়নি ওর। জাহাজের এয়ারকন্ডিশনিং ব্যবস্থা মোটেও জুতসই নয়।
চার্লটনদের কিংবা জেনের দেখা নেই। একটা ডেক চেয়ার টেনে নিয়ে, যাত্রীদের জন্যে নির্দিষ্ট ডেকের ছোট্ট অংশটায় বসল রানা। হঠাৎ খর্‌-খর্‌ শব্দ শুনে চোখ তুলতে জেনকে দেখতে পেল। আরেকটা ডেক চেয়ার টেনে আনছে ইস্পাতের ডেক পে−টের ওপর দিয়ে।
‘আমাদের ইংরেজ বন্ধুরা মনে হয় সকালের রোদ পছন্দ করে না,’ বলল যুবতী। জবাবে মুচকি হাসল কেবল রানা। কাটঅফ জিনস ও ব্যাকলেস হল্টার পরনে জেনের, উন্মুক্ত গায়ের চামড়া রোদে পোড়া তামাটে। ডেক চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসল ও, স্যান্ডেল লাথি মেরে খসিয়ে সিগারেট ধরাল।
‘মাসুদ রানা, এখন অভিনয় ছেড়ে বোধহয় কথাবার্তা বলা যায়।’
‘তথাস্তু। এরজন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।’
‘বিসিআই তোমাকে অনেক কিছুই জানায়নি।’
‘অনেক কিছু বলতে?’
‘রবার্তো মালদিনি সম্পর্কে ইনফর্মেশন। দায়িত্বটা সিআইএ আমার ওপর চাপিয়েছে। লেটেস্ট খবর হচ্ছে জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট মারা পড়ার আগে একটা রিপোর্ট ফাইল করে গেছিল। আমরা সেটা ইন্টারসেপ্ট করি। আমাকে বলা হয়েছে জিওনিস্টদের নতুন একজনের সাথে লিয়াজোঁ করে চলতে। কিন্তু
ইথিওপিয়া পৌঁছানর আগে পরস্পরকে চিনব না আমরা।’ সিগারেটটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল জেন। ‘কিন্তু আমি বাজিয়ে দেখে বুঝে ফেলেছি, সেই এজেন্ট হচ্ছে এই জাহাজের স্টুয়ার্ড।’
‘আগে মালদিনির কথা বলো,’ বলল রানা।
‘ধীরে, আকবর, ধীরে-ইংরেজ বন্ধুদের সম্বন্ধে দেখছি ভুল ধারণা করেছিলাম।’
চার্লটন দম্পতি ডেক চেয়ার হিঁচড়ে আনছেন। রানার সঙ্গে বই রয়েছে, কিন্তু পড়ার ভান করল না। মেরা আউটফিট রাখার খুদে বীচ ব্যাগটার ভেতর হাত ভরে দিল জেন। ৩৫ এমএম-এ টেলিফটো লেন্স পেঁচিয়ে ফেলল ত্রস্ত হাতে, উড়ুক্কু মাছের রঙিন ছবি নেয়ার চেষ্টা করবে বলে ঘোষণা দিল। ক্যামেরা স্থির রাখতে
রেইলের ওপর ঝুঁকে পড়ল সে।
রানার মাথায় তখন পাক খাচ্ছে নানান চিন্তা। ববি মুর, শেপ মাইয়ারের স্টুয়ার্ড, জিওনিস্টের এজেন্ট! বিসিআই তথ্যটা ওকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে, নাকি চেয়েছে রানা জেনের কাছ থেকে জানুক? রাহাত খানের ভ্রূ দেখতে পেল রানা মনের চোখে। ইচ্ছে করেই ওকে ব্লাইণ্ড মিশনে পাঠানো হয়েছে? বুকের মাঝে অভিমান উথলে উঠল ওর। পরমুহূর্তে নিজেকে ছিছি করল। জেনে-বুঝে কখনোই ওকে এরকম ফাঁকি দেবেন না বস। বিসিআই তথ্যটা তাঁকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে, এছাড়া ব্যাপারটার আর কোন ব্যাখ্যা নেই। যাই হোক এই মিশনে রানার পাশাপাশি কাজ করতে পাঠানো হয়েছে সিআইএ এজেন্ট জেন এসেক্সকে। এবং মালদিনি সম্পর্কে আরও জানতে হলে রানাকে নির্ভর করতে হবে মেয়েটির ওপর। তেমনভাবেই সাজানো হয়েছে সেটআপটা। সাজিয়েছে সিআইএ। অগত্যা স্বামী-স্ত্রীর ভ্যাজর ভ্যাজর হজম করে সকালটা
পার করতে হলো ওকে।
সন্ধে নাগাদ জর্জটাউন পৌঁছল ওরা। কিন্তু রানা মনস্থির করল তীরে নামবে না। আলী আকবরের পকেটে টান পড়েছে এবং ভ্রমণের ক্লান্তিতে বড্ড বিরক্ত বোধ করছে সে। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের কাছে মাসুদ রানার নামে একটা ফাইল আছে। কি আছে ওতে জানে না রানা, কিন্তু ববি মুর সম্ভবত শনাক্ত করতে
পেরেছে ওকে। স্থানীয় ইসরাইলী এজেন্টকে একটা খবর দিলে খুন করে গুম করে ফেলবে রানাকে। আলী আকবর নামে জনৈক আমেরিকান অভিবাসী যদি হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, কেউ আটকে রাখবে না শেপ মাইয়ারকে।

‘সাইটসিয়িঙের জন্যে যাবেন না?’ মিসেস চার্লটন প্রশ্ন করলেন।
‘না, মিসেস চার্লটন,’ বলল রানা। ‘সত্যি বলতে কি, ভ্রমণ তেমন একটা ভালবাসি না আমি। তাছাড়া সঙ্গে টাকা-পয়সাও বিশেষ নেই। ইথিওপিয়া যাচ্ছি যদি একটা হিলে− হয়। প্রমোদভ্রমণে আসলে বেরোইনি আমি। টাকা-পয়সা থাকলে…’
ত্বরিত নিষঙঊান্ত হলেন ভদ্রমহিলা, স্বামীকে পেছনে হিড়হিড় করে টানতে টানতে। এই লোককে খাওয়ার ও ব্রিজ খেলার সময় তিতিবিরক্ত করে মারা যায়, কিন্তু তাই বলে উপকূলে নামতে রাজি করাতে একটির বেশি দুটি শব্দ খরচ করতে বয়েই গেছে তাঁর। হায়রে, সবই আলী আকবরের কভারের দোষ, তেতো মনে ভাবল রানা। শালার অভাবী মানুষকে সবাই ডরায়।
জেন তীরে গেছে। কভার বজায় রাখতে হলে যেতেই হবে, রানাকে যেমন বসে থাকতে হবে জাহাজে। মালদিনির ব্যাপারে একান্তে কথা বলার সুযোগ এখনও পায়নি ওরা, কখন পাবে তাই বা কে জানে। ক্যাপ্টেন আর সেকেন্ড মেট বাদে জাহাজের বাদবাকি অফিসাররাও ডিনারের সময় তীরে নেমে গেছে।
অফিসার দু’জনের সঙ্গে সাত-পাঁচ গল্প করে সময় পার করল রানা; যদিও জমাতে পারল না।
ডিনার-পরবর্তী কনিয়্যাক পান শেষে, তীরে যাওয়ার জন্যে ক্যাপ্টেনের অনুমতি চাইল ববি মুর।
‘জাহাজে প্যাসেঞ্জার রেখে তুমি…’
‘কোন অসুবিধা নেই আমার,’ বলে উঠল রানা। ‘ব্রেকফাস্টের আগে আমার আর কিছু লাগবে না।’
‘আপনি যাচ্ছেন না, মিস্টার আকবর?’ জানতে চাইল ববি মুর।
‘না,’ বলল রানা, ‘আসল কথা, ট্যাঁক খালি।’
‘জর্জটাউন কিন্তু ভারী সুন্দর জায়গা, পরে পস্তাবেন,’ বলল ও।
ব্যাটার সাফাই শুনলে খুশির সীমা থাকবে না জর্জটাউন ট্যুরিজমের, কিন্তু রানা আগ্রহ দেখাল না। রানাকে উপকূলে চাইছে ববি মুর, কিন্তু এ ব্যাপারে চাপাচাপি করতে ভয়ও পাচ্ছে। যদি সন্দেহ করে বসে রানা। সে রাতে লুগার আর স্টিলেটোটা হাতের কাছে রাখল রানা।
পরদিনও চোখের আড়ালে থাকল ও। সাবধানতাটুকু সম্ভবত বৃথা গেল। ববি মুর তীরে নেমেছিল তেল আবিবকে জানাতে, রানা মাসাওয়া যাচ্ছে। আর সেজন্যে যদি নেমে না থাকে তাহলে চিনতে পারেনি ওকে। চিনতে পারলেও রানার করার কিছু নেই।
‘জর্জটাউনে আকর্ষণীয় কোন স্টোরি পেলে?’ সে রাতে ডিনারে বসে জেনকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘নাহ্‌, কিচ্ছু লাভ হয়নি নেমে।’
ডিনারের পর কেবিনের দরজায় মৃদু একটা আওয়াজ হবে আশা করছে রানা। দশটা বেজে সাত। চার্লটনরা আজ অন্যান্য দিনের চাইতে আগেভাগে কেবিনে আশ্রয় নিয়েছে, স্পষ্টতই ক্লান্ত। গত রাতের সাইটসিয়িঙের ধকল। জেনকে ঢুকতে দিল রানা। সাদা স্ল্যাক্স ও বডিশার্ট পরনে ওর।
‘ববি মুর তোমাকে চিনে ফেলেছে মনে হচ্ছে,’ বলল ও। রানাকে মাথা নাড়তে দেখে বলল, ‘মেইন ডেকের সুপারস্ট্রাকচারের কাছে দেখা করতে বলেছে আমাকে। রাত একটায়।’
‘তুমি চাইছ তোমাকে কাভার করি আমি?’
‘সেজন্যেই সাদা কাপড় পরেছি। আমাদের রেকর্ডে বলে, ছুরিতে তোমার নাকি হাত চালু, আকবর।’
‘অপেক্ষা করব আমি, আমাকে খোঁজার দরকার নেই,’ বলল রানা।
সায় দিল জেন।
নিঃশব্দে দরজা খুলে নগড়ব পায়ে প্যাসেজওয়েতে মিশে গেল মেয়েটা। স্টিলেটো তুলে নিল রানা। ঘরের বাতি নিভিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর সন্তর্পণে প্যাসেজওয়েতে ঢুকে পথ করে দরজাটার কাছে চলে এল, মেইনডেকের পোর্টসাইডের দিকে খোলে এটা। আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বেশিরভাগ কার্গো শিপের মত শেপ মাইয়ারেরও বিশৃক্মখল অবস্থা। সুপারস্ট্রাকচার লাগোয়া ডেকে তেরপলের ছড়াছড়ি। রানা সাবধানে গোটা দুই জড়ো করে কার্গো বুমের বেস ঘিরে স্তূপ করে
রাখল। এবার বসে পড়ল ওগুলোর আড়ালে। ববি মুর এগুলোকে কুশন না বানালেই বাঁচি, বলল মনে মনে।
ওয়াচ-অ্যাফট বসানোর ধার ধারেনি শেপ মাইয়ার। ক্রুদের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে ব্রিজে এসে মিশেছে ইনবোর্ড প্যাসেজওয়ে, রেডিও শ্যাক, এঞ্জিন রূম আর গ্যালী। রানার ধারণা হলো ব্রিজের লুকআউট ঘুমাচ্ছে, এবং অটোমেটিক পাইলটে চলছে জাহাজ। তবুও, আড়াল ছাড়ল না ও।
ঠিক একটায় দেখা দিল ববি। মেস জ্যাকেট পরে রয়েছে এখনও, আবছা সাদাটে দেখাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। বাঁ আস্তিন হাতড়াতে দেখল ওকে রানা, সম্ভবত ছুরি লুকানো আছে। এবার উদয় হলো জেন। রানার ডান হাতে উঠে এল স্টিলেটো।
কথোপকথনের টুকরো-টাকরা কেবল বাতাসে ভেসে আসছে ওর কানে।
‘তুমি আমাদের ডাবলμস করেছ,’ বলল লোকটা।
জেনের জবাবটা উড়ে গেল বাতাসে।
‘ও জাহাজে ওঠার সময়ই চিনতে পেরেছি,’ বলছে ববি। ‘তেল আবিব থোড়াই পরোয়া করে মাসুদ রানা মাসাওয়া পৌঁছল কি না।’
‘আমি করি।’
উত্তর শোনা গেল না লোকটার।
উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে বোঝা যায়, এবং সেই সঙ্গে মৃদুতর হচ্ছে ওদের কণ্ঠস্বর। রানার দিকে পিঠ দিয়ে জেনকে মেটাল সুপার স্ট্রাকচারটার উদ্দেশে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ববি, ব্রিজের যে কারও চোখের আড়ালে। আলগোছে তেরপল তুলে বেরিয়ে এল রানা, প্রায় হামাগুড়ির ভঙ্গিতে। হাতে স্টিলেটো তৈরি ওর, গুড়ি মেরে এগোল ওদের উদ্দেশে।
‘তোমার সাথে কাজ করব না আমি,’ বলল ববি।
‘মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?’
‘তুমি ডাবলক্রস করেছ আমাকে — আর নয়তো তোমার প্রভুরা। আগে তোমাকে খতম করব, তারপর রানাকে। সাগরে কেমন সাঁতরাতে পারে শালা মুসলমানের বাচ্চা দেখা যাক।’
আস্তিনের কাছে হাত চলে গেল ওর। পা টিপে দৌড়ে এসে পেছন থেকে ছুরি-ধরা বাঁ হাতে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরল রানা, রুদ্ধ করে দিল চেঁচানর সুযোগ। তারপর এক ঝটকায় ঘুরিয়ে দিয়ে পরপর দুটো বিরাশি সিক্কার ঘুসি ঝাড়ল লোকটার নাক বরাবর। মাথা ঘুরে টলে উঠতে, মেস জ্যাকেট থাবা মেরে ধরে রেইলের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল শরীরটা। জোর বাতাসে চাপা পড়ে গেল লোকটার আর্তচিৎকার। ‘ঝপাৎ’ শব্দটা নিশ্চিন্ত করল রানাকে। মাত্র ক’মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল পুরোটা।
ব্রিজ থেকে কোন শোরগোল উঠল না। পায়ের নিচে জাহাজের আফ্রিকাগামী এঞ্জিন ধড়ফড় করছে। স্টিলেটো খাপে ঢুকিয়ে জেনের কাছে এল ও। সুপারস্ট্রাকচারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে।
‘থ্যাঙ্কস, রানা…ইয়ে, আকবর।’
‘পুরোটা শুনতে পাইনি,’ জানাল রানা। ‘ও কি তেল আবীবে রিপোর্ট করেছিল আমার সম্পর্কে?’
‘কিছু বলেনি আমাকে।’
‘শুনলাম মাসাওয়া গেলাম কি গেলাম না তাতে নাকি তেল আবিবের কিছু আসে যায় না।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু খুব সম্ভব ও কোন রিপোর্ট তৈরি করেনি।’
একটুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল, ‘রানা…আকবর, ওকে কি মেরে ফেলেছ?’
মৃদু হাসল রানা, মাথা নাড়ল। ‘জানি না। কপাল ভাল থাকলে বেঁচেও যেতে পারে।’
‘জবর দেখিয়েছ কিন্তু,’ বলল জেন। একটু আগে যে মরতে বসেছিল তার কোন ছাপ দেখা গেল না মেয়েটির আচরণে। যেন এমনি ঘটনা ওর জীবনে হরহামেশাই ঘটছে। ‘তোমার কেবিনে চলো, কথা আছে,’ শেষমেষ রানাকে বলল ও।

০৩,
‘এই জাহাজে ঘাপলা আছে,’ কেবিনে ঢুকে মূর্তি হয়ে বসল জেন।
‘স্পীড কম। এয়ারকন্ডিশনিং ঠিক মত কাজ করে না। আর ববি মুর জঘন্য কফি বানাত, এই বলবে তো?’
‘না।’
ওকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিতে অপেক্ষা করছে রানা।
‘রানা,’ বলল মেয়েটি, ‘শেপ মাইয়ার সম্পর্কে বিসিআই তোমাকে কি কি জানিয়েছে বলবে আমাকে?’
‘একসময় না একসময় জাহাজটা মাসাওয়া পৌঁছবে। এবং প্যাসেঞ্জার লিস্টে সম্ভবত কোন গন্ডগোল নেই।’
‘ক্রুদের সম্পর্কে কিছু বলেনি?’
‘ববি সাহেবের কথা জানা ছিল না,’ বলল রানা।
‘সিআইএ আমাকে বলেছে তোমাকে জানাতে। আর আমা ওপর আরও একটা দায়িত্ব চাপিয়েছে। তিনটে মিনিটমেন মিসাইল ট্র্যাক করতে হবে। খোয়া গেছে ওগুলো।’
‘কমপি−ট মিসাইল?’
‘না-অংশবিশেষ। সঙ্গে নিউক্লিয়ার ওঅরহেড রয়েছে।’
‘কোথায় ওগুলো?’
‘ব্রিজের পেছনে এক নম্বর ডেকে, দড়ি বাঁধা হয়ে বসে আছে কন্টেইনারগুলোর মধ্যে।’
‘তুমি ঠিক জানো?’
‘ফেয়ারলি।’
‘মালদিনির কাছে চালান করা হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, ববি মুর বেশি বেশি মাতব্বরী ফলাচ্ছিল। আমার বিশ্বাস মাসুদ রানাকে খতম করার চাইতে ওই মিসাইলগুলো অকেজো করাটাই জিওনিস্টের জন্যে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট ছিল।’
‘তার মানে আমাদের এখন ইসরাইলী সহযোগিতা ছাড়াই কাজটা করতে হবে,’ বলল রানা। ‘যাকগে, রাতটা থেকে যাও এখানে।’
‘আর আমার চরিত্র ধ্বংস হোক?’
‘তখন চার্লটনদের সামনে যা বললে তারপর আর ধ্বংস হতে বাকি আছে কিছু?’
হেসে ফেলল জেন। বলল, ‘তবু আমার কেবিনেই শোবো আমি।’
এখন অবধি অল্প কিছু ক্রুর সঙ্গে দেখা হয়েছে রানার। ওদের কথাই ভাবছে। যাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করে না তারা। ডিনারে ক্যাপ্টেন জোহানসনের সঙ্গে গল্প করেছে রানা। মিস্টার ম্যাকলিন সেকেন্ড মেট, শুনেছে। ফার্স্ট মেট, মিস্টার জন কেয়ার, মাঝেমধ্যে খোঁত-খাঁত করে অভিবাদন জানিয়েছে এবং পাতে আরও আলু চেয়েছে, কিন্তু বাহ্যত একবারও মনে হয়নি যাত্রীরা বাঁচল না মরল তাতে কিছু এসে যায় তার। পার্সার, মিস্টার বর্গ, রানাদের খাওয়ানোর দায়-দায়িত্ব ববি মুরের ঘাড়ে চাপিয়ে, চুপচাপ দৈনন্দিন পাঁচ হাজার ক্যালোরি হজম করে গেছে। রেডিও অপারেটর, লম্বা, সোনালী চুলের লিকলিকে মেয়েটি সুইডিশ; মেরী এন্ডারসন। ফার্স্ট মেটের মতই চাপা স্বভাবের। এক কথায়, ওয়ার্ডরূমে সামাজিকতার কোন বালাই নেই।
রানা কান খাড়া রাখল যদি ববির খোঁজে হৈ-চৈ পড়ে জাহাজে। কোনমতে রাত কাবার করে, সকালে জেনকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে এল প্যাসেজওয়েতে। আরেকটু হলেই ধাক্কা খেত ওরা মেরী এন্ডারসনের সঙ্গে।
‘ববি মুরকে তোমরা কেউ দেখেছ?’ প্রশ্ন করল ও।
‘ডিনারের সময় দেখেছি,’ বলল রানা। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল জেন, সে-ও তখনই শেষবার দেখেছে।
মেরী এন্ডারসন ওদের ওপর সন্দেহের দৃষ্টি বুলিয়ে চলে গেল পাশ দিয়ে। পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল একবার ওরা।
‘দশ মিনিট পর আমার কেবিনে এসো,’ বলল জেন। ‘একসাথে নাস্তা করব আমরা।’ সানন্দে রাজি হলো রানা।
কেবিনে ফিরে এসে তৈরি হয়ে নিল রানা। অস্ত্র সঙ্গে রাখার বিষয়ে আরেকবার মাথা ঘামাল। এই জাহাজে করে তিনটে মিনিটম্যান আইসিবিএম তৈরির মাল-মশলা চলেছে, জেনের এ থিয়োরি বলছে ঠিকই করেছে রানা। কোডেড মেসেজ পাঠানোর জন্যে রেডিও ব্যবহার না করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। ক্রুরা হয়তো জানে না কি বহন করছে তারা, কারণ কার্গো শিপে কন্টেইনার খোলার কোন নিয়ম নেই। কিন্তু যদি জানা থাকে ওদের? তবে কি এখন থেকে অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা আরম্ভ করবে রানা?
খানিকটা অনুতাপের সঙ্গে লুগার আর স্টিলেটো সুটকেসের গোপন কুঠুরীতে রেখে দিল রানা, খুদে গ্যাস বোমাটা আর ট্র্যান্সিভারও রয়েছে ওখানে। এ জাহাজ ঠিকঠাকমত ইথিওপিয়া গেলে তো ভালই, নইলে একটামাত্র লুগার নিয়ে এতবড় ঝামেলা এড়ানো যাবে না। জাহাজের এঞ্জিনিয়ারদের কারও দেখা পায়নি ভেবে মনে মনে উদ্বিগড়ব হয়ে উঠছে রানা। ববি মুর জানিয়েছিল মিসেস চার্লটনের প্রশেড়বর জবাবে, তারা নাকি নিচে থাকতে ভালবাসে, যাত্রীদের দেখা দেয় না। ওর ব্যাখ্যা তখন মেনে নিয়েছিল রানা। কিন্তু এখন কেমন যেন খুঁত-খুঁত করছে মনটা।
তালা বন্ধ সুটকেসটার দিকে আবারও চাইল রানা। জ্যাকেট পরে ঢাকা দেয়া যায় লুগার। এরচাইতে ছোটখাটো কিছু পরে লুগার গোপন করার চেষ্টা বৃথা। কিন্তু এই পচা গরমে জ্যাকেট পরলে জাহাজের সবচাইতে সরল সাদাসিধে ক্রুটিও সন্দিহান হয়ে উঠবে। এবং জাহাজে সরল মনের ক্রু আদৌ কেউ আছে কিনা ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে ওর।
প্যাসেজওয়েতে পা রাখল নিরস্ত্র রানা, দরজা লক করে ক’গজ দূরে জেনের কেবিনের উদ্দেশে এগোল। আলতো টোকা দিল ও। জেন ভেতর থেকে ডাকতে ঢুকে পড়ল।
মেয়েলি অগোছাল দৃশ্য চোখে পড়বে ভেবেছিল রানা, কিন্তু তার বদলে দেখতে পেল ছিমছাম এক কেবিন। বাঙ্কের নিচে জেন সযতেড়ব ঢুকিয়ে রেখেছে লাগেজ, ওপেন ক্লজিটে নিরাপদ ওর গ্যাজেট ব্যাগ। রানা ভেবে পেল না ওর ক্যামেরা .২২ সিঙ্গল শট ধারণ করছে কিনা, কোন একটা লেন্সে।
জেন পরে রয়েছে ব্লু হল্টার আর ডেনিম কাটঅফ। পায়ে আজ স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, অস্ত্র বহন করছে না যুবতী। ব্রেকফাস্টের জন্যে ওয়ার্ডরূমে গেল ওরা একটু পরে।
পুরোটা সময় ধরে ববি মুরের অনুপস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা চলল। মিসেস চার্লটনের ধারণা সাগরে পড়ে গেছে লোকটা। কিন্তু প্রতিবাদ করল রানা, বলল তাহলে কেউ না কেউ শুনতে পেত। কিন্তু ওর কথা কানে তুললেন না ভদ্রমহিলা। পাল্টা বললেন লুকআউট কাজ ফেলে ঘুমালে শুনবে কিভাবে? এবার আপত্তি করে উঠল পার্সার। মিস্টার কেয়ার ও মিস্টার ম্যাকলিন থাকতে দায়িত্ব পালনে গাফিলতির নাকি প্রশ্নই ওঠে না। বিস্বাদ কফি, পোড়া টোস্ট আর সঙঊ্যাম্বল্‌ড্‌ এগ দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। আজ ওদের প্রতি কেমন শীতল আচরণ করলেন চার্লটন দম্পতি। ওদের বন্ধুত্ব সম্ভবত সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না ওঁরা। একদিক দিয়ে ভালই হলো রানাদের জন্যে। ববি মুরের জন্যে পর্যাপ্ত হা-হুতাশ করে জেনের কেবিনের দিকে পা বাড়াল ওরা।
‘জার্নালিস্টের ভান যখন ধরেছি তখন ববির সম্পর্কে একটু খোঁজ-খবর নিতে হয়,’ রানাকে বলল জেন। ‘তুমি কি করবে ভাবছ?’
‘কি আর, পোর্ট ডেকে গিয়ে আরেকটা জেমস হেডলি চেজ ধরব।’
‘এই,’ আদুরে কণ্ঠে বলল জেন। ‘আমার কিছু ছবি তুলে দাও।’
আঁতকে ওঠার ভান করল রানা। ‘মানে জন্মদিনের পোশাকে?’
‘তা নয় তো কি?’
‘কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে?’ বলল রানা। ‘এমনিতেই আমাদের মেলামেশা লোকে ভাল চোখে দেখছে না। তার ওপর আবার যখন তখন কেবিনে ঢোকা, কেমন দেখায় না?’ মেয়েটার মনোভাবের হঠাৎ পরিবর্তনে বিস্মিত হয়েছে ও।
মাথা নেড়ে স্বীকার করল জেন। ওকে সান্ত্বনা দিল রানা, বলল, ‘পরে সুযোগ মত তুলে দেব। এখন চলি।’ জেনকে ওর কেবিনে পৌঁছে দিয়ে চলে এল ও।
একটু পরে, ডেক চেয়ারে আয়েশ করে বসে তখন রানা, মুখটা ছায়ায় রাখার ব্যবস্থা করে সবে চোখের সামনে তুলতে যাবে বইটা, পায়ের শব্দ ও তারপর এক পুরুষকণ্ঠ কানে এল ওর। ‘মিস্টার রানা, নড়বেন না।’
রানা উপেক্ষা করার ভান করল। রানা আবার কে, অন্য কাউকে বলছে হয়তো।
‘মিস্টার আকবর, নড়াচড়া করবেন না।’
এবার আর গায়ে না মেখে উপায় কি? সেকেন্ড মেট ম্যাকলিনের গলা। দু’জন নাবিক, সশস্ত্র, রানার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার দেখা দিল ম্যাকলিন। তার হাতেও অস্ত্র।
‘জেনারেল মালদিনি আপনাকে জ্যান্ত চান,’ বলল সে।
‘এই জেনারেল মালদিনিটা কে?’
‘যাঁকে ইথিওপিয়ান সরকারের হয়ে খুঁজছেন আপনি।’
‘ম্যাকলিন, জেনারেল মালদিনি না কি, তাকে চাকরি দিতে ঠেকা পড়েনি ইথিওপিয়ান সরকারের।’
‘অনেক হয়েছে, মিস্টার রানা। ববি মুরকে খুন করেছেন আপনি। গাধা বেচারা-ইসরাইলীরা নিশ্চয়ই খুব সস্তায় কিনেছিল ওকে।’
‘মানুষকে বেহুদা অপবাদ দেয়া ঠিক নয়,’ বলল রানা। ‘খুঁজে দেখোগে, কোথাও হয়তো মাল টেনে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।’
কথার পিঠে কথা বলার সুরে জবাব দিল ম্যাকলিন। ‘ভেবে অবাক লাগে, বাচাল বুড়িরাও মাঝেমধ্যে ফস করে কেমন সত্যি কথা বলে বসে। কাল রাতে লুকআউট ঘুমাচ্ছিল। বেশিরভাগ রাতেই ঘুমায়। কিন্তু আমি জেগে ছিলাম। ববির জন্যে জাহাজ ঘুরাতে চাইনি। জিওনিস্ট এজেন্ট পানিতে পড়লে আমার কি?’
‘ইসরাইলের অনেক কিছু।’
‘স্বীকার করছি আপনার নার্ভ খুব শক্ত। কিন্তু আমরা সশস্ত্র, আপনি তা নন। এ জাহাজের সমস্ত ক্রু মহান নেতা মালদিনির লোক-শুধু ববি মুর, যাকে ফেলে দিয়েছেন আপনি জাহাজ থেকে এবং ওই এঞ্জিনিয়ারগুলো ছাড়া, এঞ্জিন রূমে এখন বন্দী হয়ে আছে ওরা। আপনার ছোরাটা কই, মিস্টার রানা?’
‘ববির শরীরে।’
‘আমি দেখেছি ওটা ব্যবহার করেননি আপনি।’
‘তুমি রাতকানা মনে হচ্ছে,’ বলল রানা। ‘কি দেখতে কি দেখেছ।’
‘যাকগে। ওটা এখন আপনার সাথে নেই। আপনি অতুলনীয়, মিস্টার রানা। কিন্তু অস্ত্রধারী তিনজনের বিরুদ্ধে অসহায়। কাজেই আস্তে করে উঠে পড়ে সামনে হাঁটা দিন। ঘুরবেন না। কোন ফন্দিফিকির করতে যাবেন না। জেনারেল মালদিনি আপনাকে জ্যান্ত চান যদিও, তবে মারা পড়লেও খুব একটা দুঃখ পাবেন বলে মনে হয় না।’
রানার দায়িত্ব মালদিনির পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত হওয়া। এখন সেধে যখন তার কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে, আপত্তি কিসের? তাছাড়া সশস্ত্র তিনজনের বিপক্ষে কিইবা করার আছে ওর। বিশেষ করে রানার দক্ষতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দ্বিগুণ সতর্ক রয়েছে যখন ওরা।
পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে তপ্ত সূর্যটা। সামনে হেঁটে গেল ওরা, পাশ কাটাল দড়িবদ্ধ কন্টেইনারগুলোর। শেষবারের মত মহাসাগরে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রানা। তারপর একটা দরজা পার হয়ে ফরোয়ার্ড সুপারস্ট্রাকচারে পা রাখল।
‘থামুন!’ আদেশ করল ম্যাকলিন।
রেডিও শ্যাকের দশ ফিটের মধ্যে এখন রানা। বেরিয়ে এল মেরী এন্ডারসন, রানার তলপেট বরাবর ধরে রয়েছে একটা কাটা শট-গান।
‘ক্যাপ্টেন বলেছেন, বোসান’স লকারের নিচে স্টোরেজ এরিয়া ব্যবহার করতে,’ বলল মেরী।
‘সে তো একদম নাক বরাবর,’ বলল ম্যাকলিন। ‘তো?’
‘ইংরেজ দম্পতি দেখে ফেলতে পারে আমাদের। হাজার হলেও মিস্টার রানা এখন অসুস্থ রোগী। ভয়ঙ্কর ট্রপিকাল ফিভারে ধরেছে তাঁকে।’
‘অসুস্থ রোগীদের বয়ে নিয়ে যেতে হয়,’ বলল মেরী।
কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে মাথা খাটাতে হলো না রানার। পেছনে পদশব্দ হলো ওর। পরমুহূর্তে সাতটা সূর্য দপ করে জ্বলে উঠল রানার মাথার মধ্যে। এখন ঘনঘোর অন্ধকার।

০৪,
অসহ্য মাথার যন্ত্রণা নিয়ে জ্ঞান ফিরল মাসুদ রানার। মনে হচ্ছে ওর মাথার ভেতর অমলেন্দু বিশ্বাসের যাত্রাপার্টি শো করছে। নগড়ব বাতিটা সরাসরি মুখের ওপর হামলা করায় চোখ বুজতে বাধ্য হলো। গুঙিয়ে উঠে কোথায় রয়েছে ভাবার চেষ্টা করল ও।
‘রানা?’ নারীকণ্ঠ।
খোঁত করে জবাব দিল ও।
‘রানা?’ মহিলা বলল আবার, কণ্ঠে জরুরি তাগিদ।ব্যথা সত্ত্বেও চোখ খুলল রানা। ওয়ায়্যার ডোরটা তৎক্ষণাৎ নজর কাড়ল ওর। ম্যাকলিন। মেরী এন্ডারসন। তার শটগান। বোসান’স লকারের নিচে স্টোরেজ এরিয়ার কথা বলেছিল কে যেন। জেনের পেছনেও লেগেছিল ওরা। বাঁয়ে এক গড়ান দিতে জাহাজের এক পাশে দলামোচা হয়ে ওকে পড়ে থাকতে দেখল। চোখের নিচে কালসিটে পড়ে চেহারার সৌন্দর্যহানি ঘটেছে যুবতীর।
‘কে মেরেছে? কে বকেছে, কে দিয়েছে গাল?’
‘ম্যাকলিন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে কাবু করে ফেলেছে। তারপর মুখ বেঁধে স্ট্রেচারে করে নিয়ে এসেছে এখানে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ক্যামেরাটা ভাঙেনি, আমার গলাতেই
ঝুলছিল যদিও।’
ওর কাহিনীর দুটো বর্ণনা ঠিক যেন মিলছে না। ক্যামেরা ভাঙেনি, কথাটা এমন দায়সারাভাবে বলল যেন নিজে থেকেই চাইছে রানার মনে সন্দেহ জাগুক। এবং একজন এজেন্ট হিসেবে, ওর ন্যুনতম কমব্যাট স্কিল থাকা উচিত ছিল। ম্যাকলিনের সঙ্গে যুঝতে পারবে আশা করেনি রানা, কিন্তু খানিক ক্ষতি তো অন্তত
করবে। সতর্কতাই বা অবলম্বন করল না কেন?
অতিকষ্টে উঠে দাঁড়াল রানা। খুদে কম্পার্টমেন্টটা জাহাজের গতির চাইতে দ্রুত ও বেপরোয়াভাবে দুলছে। বমি পাচ্ছে রানার। ম্যাকলিন ব্যাটা ড্রাগ দিতে পারল না? একটা নির্দিষ্ট সময় পর প্রভাব কেটে যায় ইঞ্জেকশনের। কিন্তু মাথায় আঘাত পেলে অনেক দিন, সপ্তাহ এমনকি মাস অবধি মাথা ঝিম্‌ঝিম্‌ করতে পারে।
‘রানা, তুমি ঠিক আছ তো!’ কোমর জড়িয়ে ধরল জেন রানার। নিচু করে বসিয়ে দিল স্টীল ডেকে, জাহাজের কিনারে বিশ্রাম পাচ্ছে রানার পিঠ। ‘তুমি ঠিক আছ তো?’ বলল ফের।
‘শালার জাহাজটা কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে,’ বলল রানা। ‘ম্যাকলিনের বাচ্চা ভাল বাড়িই মেরেছে।’
ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে চোখ পরীক্ষা করল জেন। পালস পরখ করল। তারপর আলতো করে হাত বোলাতে লাগল মাথার পেছন দিকে। জখমে হাত পড়তে ককিয়ে উঠল রানা।
‘হ্যাং অন,’ বলল জেন।
মেনে নিল রানা। মনেপ্রাণে আশা করছে কোন চিড় খুঁজে পাবে না জেন।
উঠে দাঁড়িয়ে এসময় বলল যুবতী, ‘ফার্স্ট এইড খুব একটা বুঝি না আমি, রানা। কিন্তু মনে হচ্ছে না বড় ধরনের কোন আঘাত বা ফ্র্যাকচার হয়েছে। কয়েকটা দিন একটু ভোগাবে।’
হাতঘড়ি দেখল রানা। তিনটে দুই। ‘দিনটা তো আজই, তাই না?’
‘মানে যেদিন ওরা আমাদের বন্দী করল? হ্যাঁ, কেন, কি করবে?’
‘খুব সাবধানে মুভ করব, যখন করব আর কি, এবং আশা করব ওপরে কোন কিছুই পার্মানেন্টলি রিঅ্যারেঞ্জ করা হবে না।’
‘আমি এখান থেকে বেরনোর কথা ভাবছিলাম,’ বলল জেন।
‘বুদ্ধি বাতলাও।’
‘আমার ক্যামেরাটা আসলে একটা টুলকিট। অল্প কিছু যন্ত্রপাতি আছে ওর ভেতর।’
‘গুড। ওরা লাঞ্চ এনেছিল আমাদের জন্যে?’
‘না।’ বিস্মিত দেখাল মেয়েটিকে।
‘মাথা গরম করার আগে অপেক্ষা করে দেখি ওরা আমাদের খাওয়ায় কিনা।’ বলল রানা। দ্বিমত করল না জেন।
ধাতব খোলের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আকাশ-পাতাল ভেবে চলল রানা। বার দুয়েক আলাপচারিতার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল জেন। কতক্ষণ এখানে আটকা থাকতে হবে ভাবছে রানা। কারাগারটিতে টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। খাওয়ার পানিরও কোন বন্দোবস্ত দেখা যাচ্ছে না। বাকেট আর পানির জগ যদি না আসে তবে বিপদ হয়ে যাবে।
চারটে বাজার একটু পরে, জেনের সঙ্গে খানিক মজা করবে ভেবে প্রশ্ন করল রানা, ‘শেপ মাইয়ারে ইঁদুর আছে মনে হয় তোমার?’
‘ইঁদুর?’ ঈষৎ ভীতি ওর কণ্ঠে। ‘আমি তো কোন ইঁদুর-টিঁদুর দেখলাম না।’
‘হয়তো নেইও,’ আশ্বস্ত করল রানা। ‘জাহাজটা যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছনড়ব। কিন্তু ইঁদুর যদি থাকে তবে এই নিচের দিকেই থাকবে।’
‘কি করে জানো আমরা নিচের দিকে আছি?’
‘জাহাজের গায়ের বাঁক লক্ষ করো,’ বলল রানা, হাত বুলাল ঠাণ্ডা খোলে। ‘নড়াচড়ার ভঙ্গি আর শব্দ খেয়াল করো।’
‘অনেকখানি নিচ পর্যন্ত বয়ে এনেছে আমাকে,’ মন্তব্য করল জেন।
এরপর দশ মিনিটের নীরবতা।
‘হঠাৎ ইঁদুরের কথা উঠল কেন?’ বলে উঠল জেন।
‘সম্ভাব্য সবরকম বিপদের কথা মাথায় রাখা ভাল,’ বলল রানা। ‘ইঁদুর তাদের একটা। ওরা বেশি মারকুটে হয়ে উঠলে পাহারা দিতে পারি আমরা পালা করে। কামড় খাওয়ার চাইতে তাও বরং ভাল।’
শিউরে উঠল জেন। মনে মনে রানার স−্যাক্স ও সুটের সঙ্গে নিজের শর্টস আর হল্টারের তুলনামূলক বিশে−ষণ করল। লোভনীয় মাংস প্রচুর পরিমাণে প্রদর্শন করছে সে। এবং যে কোন বিচারবুদ্ধি সম্পনড়ব ইঁদুর, রানার রুক্ষ চামড়ার চাইতে, জেনের কোমল মসৃণ ত্বকে কামড় বসাতে বেশি আগ্রহী হবে।
‘রানা,’ কাতর কণ্ঠে বলল জেন। ‘ইঁদুরের কথা আর বোলো না। আমার ভয় করে।’ রানার গা ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল মেয়েটা।

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, রানার ঘড়ি যদি আঘাত সয়ে সঠিক সময় দেয় আরকি, ডিনার এসে পৌঁছল। মিস্টার জন কেয়ার, ফার্স্ট মেট রয়েছে দায়িত্বে। তার তুলনায় রীতিমত সদালাপী বলতে হয় ম্যাকলিনকে।
‘খোলে হেলান দিয়ে দাঁড়াও, যদি বাঁচতে চাও,’ ব্যস, এটুকুই বেরোল ড্যাম কেয়ারের মুখ দিয়ে।
চারজন নাবিক সঙ্গে এনেছে সে। একজন সাবমেশিনগান
তাক করে রেখেছে বন্দীদের তলপেট লক্ষ্য করে। অন্যরা ব্ল্যাঙ্কেট ও একটা বাকেট ছুঁড়ে দিল, তারপর খাবার ও পানি নামিয়ে রাখল খাঁচাটার ভেতর। ওয়ায়্যার ডোর লাগিয়ে দিল থোড়াই কেয়ার সাহেব, যথাস্থানে আঙটা গলিয়ে, বন্ধ করে দিল তালা।
‘পানি দেয়া হয়েছে সারা রাতের জন্যে,’ বলল সে। ‘সকালে বাকেট খালি করা হবে। মেটাল কভার আছে ওটার।’
বন্দীরা ধন্যবাদ দেবে সে সুযোগ না দিয়েই বিদায় নিল লোকগুলো।
ট্রে দুটো তুলে নিয়ে বলল জেন, ‘চামচ-কাঁটাচামচ সব রেখে চলে গেল। ওরা কেয়ারলেস।’
‘কিংবা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী,’ বলল রানা। ‘ওদেরকে আন্ডার-এস্টিমেট কোরো না। ম্যাকলিন বলেছে, জাহাজের সব ক্রু নাকি মালদিনির চর, কেবল ওই এঞ্জিনিয়ারিং অফিসাররা ছাড়া।’
‘ও, সেজন্যেই ওদেরকে কখনো দেখা যায়নি।’
‘ঘাপলাটা আমার আগেই ধরতে পারা উচিত ছিল,’ বলল রানা। ‘ঘোলাটে ব্যাপার আছে বুঝতে পারছিলাম কিন্তু আইডেন্টিফাই করতে পারিনি।’
‘সে দায়িত্ব আমারও ছিল, রানা, তোমার একার নয়,’ সান্ত্বনা দিল জেন।
খাবারের মান ওয়ার্ডরূমের চাইতে অনেক নেমে গেছে। ঠাণ্ডা গরুর মাংস, টোস্ট আর তেলতেলে আলু। তবু তা দিয়েই কোনমতে খাওয়া সারা হলে, ইস্পাতের ডেকে ব্ল্যাঙ্কেট বিছিয়ে বিছানা পাতল ওরা। তারপর বাকেটটা নিয়ে রাখল ফরোয়ার্ড কর্নারে।
‘চার্লটনরা এখন কি করছে কে জানে,’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল জেন। ‘ওরা কি আমাদের সাহায্য…’
কথা কেড়ে নিল রানা। ‘সে আশা কোরো না। ওরা…একজোড়া সৌভাগ্যবান, বিরক্তিকর মানুষ। যদি টেরও পায় শেপ মাইয়ারে কোন গোলমাল আছে তবু টুঁ-শব্দটা করবে না। জাহাজে তো নয়ই, কেপটাউনে নেমেও না।’
‘কিন্তু এঞ্জিনিয়ারগুলো?’
‘ভরসা করা যায় না,’ হতাশ করল রানা। ‘জাহাজে মালদিনির লোক আছে ত্রিশ-চলি−শ জন। কতগুলো নিরীহ এঞ্জিনিয়ার কী করবে? তাছাড়া ওরা কিছু জানেই না হয়তো।’
‘তাহলে আমার ক্যামেরাটা হয়তো…’
‘আপাতত ভুলে যাও ওটার কথা। এখন প্রধান কাজ হচ্ছে এদের রুটিন আঁচ করা। আরও তিন-চারদিন লেগে যাবে সম্ভবত কেপ টাউন পৌঁছতে।’
মুখটা প্যাঁচার মত দেখাচ্ছে জেনের। রানার অনুমতি নিয়ে ঘরের একমাত্র বাতিটা নিভিয়ে দিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এবার শুয়ে পড়ে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিল। জাহাজের নিচের অংশ বটে, কিন্তু অত বেশি শীত লাগছে না। কেমন এক গুমোট, স্যাঁতসেঁতে ভাব। বিল্‌জ্‌ থেকে আসা গন্ধ চরম অস্বস্তিকর।
‘আঁধারে ইঁদুর আসবে না তো, রানা?’
‘সেজন্যেই বাতিটা জ্বেলে রেখেছিলাম।’
‘ধুরো, মরুকগে, মুখের ওপর আলো নিয়ে ঘুমানর চাইতে ইঁদুরও ভাল। আচ্ছা, গুডনাইট, রানা।’
‘গুডনাইট।’
কয়েক মিনিট জেগে রইল রানা। দপ্‌দপ্‌ করছে মাথার যন্ত্রণাটা। তারপর এমনই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল, টেরই পেল না, কোন্‌ ফাঁকে সকাল ছটা বেজে গেছে।

০৫,
সম্ভাব্য পরিকল্পনা আঁটতে তিনটে দিন লেগে গেল রানার। জেনকে সঙ্গে নিয়ে ছকটা এঁকেছে ও। ইতোমধ্যে মাথার জখমটা সেরে এসেছে প্রায়। আরেকবার একই জায়গায় বাড়ি না খেলে ওটা আর ভোগাবে না।
গ্রেপ্তারকারীরা দিনে তিনবার করে আসছে, নিশ্চিত হয়েছে ওরা। একবার উচ্ছিষ্ট তুলে নিয়ে যাচ্ছে, একবার বাকেট পাল্টে দিচ্ছে এবং আরেকবার জগভর্তি পানি আনছে। ছটার আগ দিয়ে ডিনার সার্ভ করে, তারপর বাকি সময়টুকু আর বিরক্ত করে না ওদের।
ওয়ায়্যার ডোরের কব্জাগুলো সম্পর্কে রানা বিশেষ ভাবে আগ্রহী। তিন বল্টু দিয়ে দৃঢ়ভাবে ধাতুদণ্ডে আঁটা ও দুটো, এবং আরও তিনটি বল্টু ধাতব দরজাটায় আটকে রেখেছে ওগুলোকে। বল্টুগুলোকে ঢিল করতে লিভারেজ ব্যবহার করা যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে রানার।
‘তোমার সঙঊু-ড্রাইভারটা লাগবে, জেন,’ বলল রানা।
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠল জেন। দুটো ঢেউয়ের মাঝে পড়ে টালমাটাল এমুহূর্তে শেপ মাইয়ার।
‘কি করবে ওটা দিয়ে?’
‘বিসিআইতে একটা মেসেজ পাঠাতে চাই, তারপর আবার এখানে এসে আটকা পড়ব তোমার সাথে। আমরা কোথায় আছি জানলে, ঢাকা বুঝবে কি করা উচিত, বা ইথিওপিয়ান কর্তৃপক্ষকে কতটা জানানো দরকার।’
একপাশে আবার কাত হয়ে গেল জাহাজ। ‘এমন রাতে বেরোয় কেউ!’ ত্রস্ত কণ্ঠে বলল জেন।
‘এটাই তো সুযোগ। সাপ্লাই নিতে লকারে কারও আসার সম্ভাবনা নেই। আমরা কোন শব্দ-টব্দ করলেও শুনতে পাবে না।’
‘স্রোতে যদি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়?’
‘ভাসালে আমাদের নয়, আমাকে ভাসাবে। এখন বলো দেখি, এই এরিয়ার হ্যাচ কোনদিকে খোলে। আমাকে তো অজ্ঞান করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ?’
‘আমরা মেইন ডেকের চার ডেক নিচে আছি,’ জানাল জেন।
‘বো-র কাছে, ডেক যেখানে তৈরি হয়েছে, ওখানে একটা হ্যাচ আছে। বড়সড় এক হ্যাচ আর মই নেমেছে দ্বিতীয় ধাপে। নিচের তিন লেভেলে, স্কাট্‌লের পাশে লম্বালম্বি মই রয়েছে।’
‘মেইন ডেকের হ্যাচটা কি ব্রিজের দিকে মুখ করে খোলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তারমানে ধরা পড়ার চান্স আরও বাড়ছে।’
ক্যামেরাটা খুলতে লাগল জেন। রীলের মাঝখান থেকে বেরোল পিচ্চি এক সঙঊুড্রাইভার। কাজেই, রানাকে একপাটি জুতো খুলে, কব্জার পিন মুক্ত করতে হীল ব্যবহার করতে হলো। উন্মাদের মত দুলে উঠল জাহাজটা, এতখানি দুলুনি সইতে হচ্ছে ওরা একদম সামনের দিকে রয়েছে বলে। পিনগুলো আলগা হয়ে গেলে, দরজাটাকে যথাস্থানে ধরে রাখল জেন এবং রানা ওগুলোকে তুলে দিল ওপরদিকে। এবার বের করে নিয়ে পিনগুলোকে রেখে দিল ব্ল্যাঙ্কেটের ওপর, এবং দু’জনে মিলে বাইরের দিকে ঠেলা দিতে লাগল তারের জালটাকে। জোর ঘষা খেয়ে ঘর-ঘর শব্দ তুলল কব্জা, তারপর বিচ্ছিনড়ব হয়ে গেল। আলগোছে দরজাটা এক মানুষ বেরনোর মত ফাঁক করল রানা। দু’মুহূর্ত পরে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে জেনের সঙ্গে আলাপটা সেরে নিল ও।
নটা বাজেনি এখনও। ঠিক হলো এগারোটার আগেই রেডিও শ্যাকে পৌঁছবে রানা। জেন তথ্য জোগাল, মেরী এন্ডারসন এসময় ওটা বন্ধ করে ক্যাপ্টেনের কেবিনে যায়। রানা মনেপ্রাণে কামনা করছে ওসময় শিথিল থাকবে পাহারা, ডিউটির অর্ধেক সময় পার করে ক্লান্ত হয়ে পড়বে লুকআউটরা।

স্কাট্‌ল তিনটে পেছনে বন্ধ করল রানা, খোলা হয়েছে ওগুলো বিশেষ নজর না দিলে বোঝার উপায় নেই। প্রয়োজনের সময়, হুইলে হালকা এক মোচড় দিলেই রানা খুলে ফেলতে পারবে। সেকেন্ড ডেকের চারধারে অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রানা, কিন্তু কোন ফাউল-ওয়েদার গিয়ার খুঁজে পেল না। কাজেই হ্যাচের মধ্যখানের স্কাট্‌ল বেয়ে উঠে পড়ল ও-মেইন ডেকে গিয়ে মিশেছে এটা-এবং বোসান্‌স্‌ লকার তল−াশী করে দেখল। কোন এক নাবিক পুরানো এক মোটা কাপড়ের ডাংগ্যারী আর একটা ফাউল-ওয়েদার জ্যাকেট ফেলে গেছে একটা বিনে। প্যান্ট ও জুতো খসিয়ে আঁটো ডাংগ্যারী আর জ্যাকেটটা গায়ে চড়াল রানা।
শেপ মাইয়ার এ মুহূর্তে হেলেদুলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছুটছে।
জাহাজের বো যখনই দেবে যাচ্ছে ঢেউয়ের নিচে ফো’ক্যাসলে আছড়ে পড়ছে পানি। স্টোরেজ এরিয়ায় আরও অনুসন্ধান চালিয়ে বড় এক টুকরো ক্যানভাস ও একটা অয়েলস্কিন হ্যাট খুঁজে পেল রানা। আরও দু’টুকরো ক্যানভাস আবিষ্কার করল ও। তোয়ালে হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বড় ক্যানভাসটা হ্যাচের পাশে ডেকে রাখবে ঠিক করল। ফাউল-ওয়েদার জ্যাকেট খুলে ফেলল ও, শার্ট খুলে, ট্রাউজার ও জুতোর সঙ্গে রেখে, জ্যাকেটটা পরে নিল আবার।
বাতি নিভিয়ে দিল রানা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, হ্যাচের প্রতিটি শিক খোলার প্রকাণ্ড লিভারটার ওপর হাত রাখল ও, অপেক্ষা করল জাহাজের বো যতক্ষণ না দেবে গিয়ে ফের উঠতে শুরু করল। তারপর হ্যাচ খুলল, ওটা গলে বেরিয়ে, ভেজা ডেকের ওপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিল। ফরোয়ার্ড সুপারস্ট্রাকচারের উদ্দেশে দৌড়াচ্ছে ও।
পতন ঘটল আবার জাহাজের বো-র। পেছনে উঁচু পানির দেয়াল অনুভব করল রানা। সুপারস্ট্রাকচারের গায়ে শরীর ছুঁড়ে দিয়ে, কোমর সমান উচ্চতার সেফটি রেইল খপ করে থাবা মেরে ধরতে চাইল। জোরাল আঘাত হানল ওর গায়ে ঢেউটা। ধাম করে ধাতব বাড়ি খেতেই হুশ করে বুক থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল রানার। ওকে ঘিরে পাক খাচ্ছে পানি, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ফেলতে চাইছে কালিগোলা রুদ্ররূপী আটলান্টিকে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল ও রেলিং, বুক ভরে নিল বাতাসে, দস্তুরমত লড়াই চালাচ্ছে ঝিম্‌ঝিম্‌ অনুভূতিটার সঙ্গে। মস্তিষ্কের নির্দেশে সাড়া দিতে চাইছে না পেশি।
পানির স্তর গোড়ালির কাছে নেমে এলে, পোর্টসাইডের দিকে ঘুরে পথ করে নেয়ার চেষ্টা করল রানা। রেইল ধরে রেখে সুপারস্ট্রাকচারের গা ঘেঁষে রইল ও। ব্রিজটা তিন ডেক ওপরে, এবং অফিসার কিংবা লুকআউট কারোরই থাকার কথা নয় এখন ওখানে। হেলমসম্যানের সঙ্গে গাদাগাদি করে পাইলটহাউজে থাকবে ওরা। রানাকে ডেক ধরে ছুটতে যদি দেখে না থাকে, তবে এখন আর দেখবেও না।
পোর্টসাইডের এক মইয়ের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতে তেড়ে এল পরের ঢেউটা। দু’হাতে এক রাং জড়িয়ে ধরে ঝুলে রইল রানা। পানির ভাসিয়ে নেয়ার শক্তি আগেরবারের চাইতে এবারে কম হলেও, জাহাজের পাশ ঘেঁষে রয়েছে বলে রানার সাগরে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। ও সুপারস্ট্রাকচারের বাঁক ঘুরতে না ঘুরতেই ডেকের ওপর দিয়ে ধেয়ে এল তিন নম্বর স্রোতটা। অল্প একটুখানি পানি কেবল ভেজাতে পারল ওর গোড়ালি।
সুপারস্ট্রাকচারের আফটার ওয়ালে হেলান দিয়ে দম ফিরে পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করল রানা। নিরক্ষরেখার কাছাকাছি রয়েছে ওরা। ফলে, পানি অতখানি ঠাণ্ডা নয় যে পায়ের পাতা অসাড় করে দেবে। সাগরের বিরুদ্ধে প্র ম বাউটে জিতে গেছে রানা। কিন্তু আরও বিপজ্জনক দ্বিতীয় দফা লড়াই এখনও বাকি রয়ে গেছে-বোসানস লকারে ফিরতি যাত্রা। তার আগে, রেডিওশ্যাকে ঢুকে, মেরী এন্ডারসনকে কাবু করে, মেসেজ পাঠাতে হবে।
দুই সুপারস্ট্রাকচারের মাঝখানের মেইন ডেকটা পরীক্ষা করল রানা। বেশিরভাগ জায়গাই ডুবে আছে অন্ধকারে, যদিও পোর্টহোলগুলো থেকে চুইয়ে আফটার সুপারস্ট্রাকচারে এসে পড়েছে ছোপ ছোপ আলো। জাহাজের মাঝখানটার দিকে সরে এল রানা এবং চট করে খুলেই লাগিয়ে দিল হ্যাচটা। টিপে টিপে পা ফেলে এবার এগিয়ে চলল ও এবং রেডিও শ্যাকের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতল।
কিছুই শোনা গেল না। রেডিও অপারেটর কোন ব্যান্ড যদি মনিটর করেও থাকে, হয় ব্রিজে বাজছে সেটা আর নয়তো এয়ারফোন ব্যবহার করছে। ভেতরে উঁকি দিল রানা। একাকী মেয়েটি। দ্রুত পায়ে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা, ভাবখানা এমন যেন শ্যাকে আসার যথার্থ কারণ আছে ওর।
বাঁয়ে কন্ট্রোল প্যানেল সামনে নিয়ে বসে আছে মেরী। কিছু টের পেয়ে মুখ তুলে তাকানোর আগেই ডান হাতের মাঝারি ওজনের এক কোপ পড়ল ওর ঘাড়ের ওপর। মুহূর্তে জ্ঞান হারাল মেয়েটি। তাড়াতাড়ি ওর পড়ন্ত দেহটা ধরে ফেলে, সামনের কী থেকে তুলে নিল। জোরাল গোলমাল হয় হোক, সার্কিট সংযুক্ত নয় ব্রিজে কিংবা ক্যাপ্টেনের কেবিনে। এখানে কিছু ঘটলে এখনই জানবে না ওরা। সাবধানে মেয়েটাকে চেয়ারের সামনে মেঝেতে শুইয়ে দিল রানা। আশা করল জ্ঞান ফিরে পাবার পর কি ঘটেছে স্পষ্ট মনে করতে পারবে না মেয়েটা; মনে করবে ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে ঘাড়ে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সাবধানে দরজা ভেজিয়ে ছিটকিনি মেরে দিল রানা। মেরীর পালস চেক করে নিশ্চিন্ত হলো, চলছে। অতিকায় ট্র্যান্সমিটারটা স্টারবোর্ড বাল্কহেডের গায়ে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওটার দিকে চেয়ে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল রানার। ও যা ভেবেছিল তার চাইতে অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী জিনিসটা।
ফ্রিকোয়েন্সি সেট করে, চাবি তুলে নিয়ে ট্রান্সমিটারের সামনে সরাসরি জুড়ে দিল। কন্ট্রোল বোর্ড কিভাবে কাজ করে অতশত ভাবার সময় নেই। রানা আশা করছে ডায়ালগুলো ওটার তুলনামূলকভাবে নিখুঁত। বিসিআইয়ের ফ্রিকোয়েন্সিতে ডায়াল সেট করল রানা। জাহাজ কোথায় আছে জানে না রানা, তবে বিসিআই হেডকোয়ার্টারের রেঞ্জের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই রয়েছে ও। যে-ই ডিউটিতে থাকুক না কেন, নিশ্চয়ই কাজ ফেলে ঘুমাচ্ছে না।
সাদামাঠা সিচুয়েশন রিপোর্ট পাঠাল রানা। কামনা করছে, যে-ই কপি করবে রাহাত খানের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেবে ওটা।
‘এম আর নাইন ধরা পড়েছে। মিশন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমেরিকার টনক নড়ায় এজেন্ট পাঠিয়েছে। এম আর নাইন কাজ করছে তার সঙ্গে। চলেছে নির্ধারিত গন্তব্যে। -এম আর নাইন।’ দু’বার পাঠাল ওটা রানা। তারপর কন্ট্রোলবোর্ডে চাবি রেখে, ট্র্যান্সমিটারে আগের ফ্রিকোয়েন্সি রিসেট করল। সন্তর্পণে এবার চলে এল দরজার কাছে।
প্যাসেজওয়ে থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল এসময়: ‘রেডিও শ্যাক বন্ধ কেন?’
‘বুড়োর কেবিনে আজ আগেভাগেই চলে গেছে হয়তো।’
‘কেন, একমাস পূরণের আগেই নিজের ডোজ শেষ করে ফেলেছে?’
‘বুড়োরটা বুড়ো ওকে দিয়ে দেবে কষ্ট হলেও; বাজি ধরতে পারো।’
‘তুমি বা আমি হলেও দিতাম। বিনিময়ে যা পেতাম সেটাও কম না!’
সশব্দ হাসি। মেইন ডেকের ওপরে যাওয়ার হ্যাচটা বন্ধ হলো দড়াম করে। লোক দুটো ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলছিল। আফটার সুপারস্ট্রাকচারে ওদের পৌঁছতে কমপক্ষে দু’মিনিট লেগে যাবে।
হঠাৎ একটা চিন্তা ঘাই মারল রানার মগজে। কিসের ডোজ? তাহলে কি কোনরকমের ড্রাগ দিয়ে লোকগুলোকে নিজের পক্ষে রেখেছে মালদিনি? ডানাকিলদের বেলায় সেটা সত্যি হতেও পারে, কিন্তু নিও ফ্যাসিস্টদেরও বারোটা বাজাচ্ছে লোকটা? ম্যাকলিন? দেখে তো মনে হয় না। নাকি সে ব্যতিμম? ভিনড়ব খাতে চিন্তাস্রোত ঘুরিয়ে দিল রানা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ওকে ধরিয়ে দেবে না তো? কিন্তু যুক্তিটা অসার ঠেকল নিজের কাছেই। শেপ মাইয়ারের মত জাহাজে এত সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ থাকতে পারে না।
আলগোছে দরজা দিয়ে বেরিয়ে, হ্যাচের উদ্দেশে তড়িঘড়ি পা চালাল রানা। বিনা বাধায় মেইন ডেকে বেরিয়ে এল। পেছন দিক দিয়ে ঘুরে, পথ করে নিয়ে সুপারস্ট্রাকচারের পাশে চলে এল রানা। এমনভাবে সময় মেপে দৌড়টা দিল, যাতে বো ডিঙিয়ে পানি আসার আগেই মইয়ের নাগাল পায়। টায়ে টায়ে পরীক্ষাটায় পাশ করল। দ্বিতীয় দফা চেষ্টায় সুপারস্ট্রাকচারের সামনের অংশে পৌঁছতে পারল ও। এবং ঢেউয়ের আঘাতে আবারও ছিটকে গিয়ে পড়ল জাহাজের ধাতব দেহে। হ্যান্ডরেইল আঁকড়ে ধরে টিকে থাকতে হলো। সামনে যে এগোবে, শরীরে জোর পাচ্ছে না রানা। কতক্ষণ লড়াই চালাতে পারে একটা মানুষ ফুঁসে ওঠা মহাসাগরের বিরুদ্ধে? আরও দুটো জলোচ্ছ্বাস আসতে দিয়ে সুপারস্ট্রাকচারের বাড়ি হজম করল রানা।
এতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্রী আবহাওয়া সহায়তা করেছে ওকে। কিন্তু এখন, এক ছুটে হ্যাচের কাছে পৌঁছতে না পারলে, ভেসে যেতে হবে জাহাজ থেকে। কাজটা মোটেই সহজ নয়। কার্গো বুম ঘেঁষে ছোটার চেষ্টা করবে ও। আবছা কালো এক আকৃতির রূপে ওটা ধরা দিচ্ছে চোখে। একবারের চেষ্টায় হ্যাচের কাছে যেতে না পারলেও, বুম আঁকড়ে ধরে সাগরের ঝাপ্টা কাটাতে পারবে আশা করছে রানা।
পানির ঢল এল আবারও, আগেরগুলোর মত উঁচু কিংবা জোরদার নয় যদিও। বো উঠে যেতে এবং পানি কমে যেতে শুরু করতেই ছপ ছপ করে সামনে এগোল রানা, কাত হয়ে পড়া পিচ্ছিল ডেকে পতন সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। হাঁটু থেকে নেমে গোড়ালির সমান এখন পানি; ধুপধাপ পা ফেলে যত দ্রুত সম্ভব ছুটছে রানা। কার্গো বুম অতিμম করল। সাঁত করে আচমকা নাক দাবাল জাহাজ-এতই ত্বরিত গতিতে যে দিগ্বিদিক্‌জ্ঞানশূন্য রানা যথাসময়ে থমকে দাঁড়িয়ে বুম ধরতে ব্যর্থ হলো। বো ঘিরে গল গল, ছপাৎ ছপাৎ নানারকম শব্দ করে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে পানি। মুখ তুলে চাইতে, মাথার ওপরে সাদা ফেনার মুকুট লক্ষ করল রানা। নিচু যে স্ট্রাকচারটার উদ্দেশে এগোচ্ছিল
ঢাকা পড়ে গেছে সেটা।
সামনে ঝাঁপ দিল মাসুদ রানা অন্ধের মত, হ্যাচ কিংবা মেটাল লেজ, কোন একটার নিচে আড়াল নিতে হবে। কামনা করছে সময়ের হেরফের করে প্রিয় মাথাটা ছাতু হতে দেবে না। টনকে টন পানি আছড়ে পড়ছে নিচে টের পাচ্ছে। শরীর এ মুহূর্তে প্রায় আনুভূমিক ওর, খোলার ও বন্ধ করার লিভারটা বাগে পেতে হাতড়াচ্ছে দুহাত। দেহের নিুাংশে আঘাত হানল পানি, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে; ডেকের দিকে টেনে হিঁচড়ে ফিরিয়ে নিতে চাইছে সুপারস্ট্রাকচারের কাছে-ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে জাহাজ থেকে। শেষ মুহূর্তে লিভারের নাগাল পেল রানার আঙুল। বাঁ হাতটা পিছলে গেলেও ডান হাত ওটাকে ছাড়ল না, কব্জি মুচড়ে গিয়ে অসহ্য ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল বাহুমূল পর্যন্ত। কাঁধের পেশি ছিঁড়ে যায় কিনা ভয় পেল রানা।
আঁটো ড্যাংগারির বাঁধনটা খুলে গেল কোমরের কাছ থেকে। ড্যাংগারিটা টেনে খানিক নামিয়ে দিয়েছে প্রবল স্রোত। ওভারহ্যাঙের নিচে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে পানি, রানার চোখে-মুখে লবণ ছিটিয়ে শ্বাস কেড়ে নিতে চাইছে। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত মাথার জখমটা এসময় দাপাতে আরম্ভ করল। শেপ মাইয়ার এক্ষুণি ঢেউয়ের নিচ থেকে নাক না তুলতে পারলে, ফো’ক্যাসলে ভাসমান ওই আলগা যন্ত্রপাতিগুলোর মত একই দশা হবে রানার।
অবিশ্বাস্য ধীর গতিতে, মনে হলো ওর, জাহাজটার বো শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করল। গাল চাটা ছেড়ে শরীরের কাছ থেকে হড়হড় করে সরে গেল পানি। গোড়ালির কাছে তালগোল পাকিয়ে গেছে ভেজা ড্যাংগারি, কাজেই হ্যাচ লিভারে হাতের চাপ দিয়ে ওপরে টেনে তুলল নিজেকে রানা। মরিয়ার মত লাথি মেরে চুপচুপে জিনিসটা দেহ থেকে খসাল ও। ছপাৎ করে ডেকের ওপর পড়ে ভেসে চলে গেল ওটা বানের পানিতে। জাহাজটা এ মুহূর্তে তরতর করে উঠে যাচ্ছে ওপরদিকে, ঢেউয়ের চূড়ায় ক্ষণিকের জন্যে চড়ে আরেকটা বিশাল ঢেউ ভেদ করার জন্যে ঝাঁপ দিল।
লিভার তোলার চেষ্টা করল রানা অনর্থক। ভুলটা বুঝতে পারল ও। শেষ ঢেউটা সামলানোর সময় রানার দেহের চাপ খেয়ে শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে ফাঁকগুলো। ওয়াটারটাইট বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে এত অটুট দৃঢ়তার দরকার পড়ে না। লিভার কেন নড়ে না এর ওপর বিশেষজ্ঞ হলেই বা লাভ কি? পরবর্তী ঢেউটা তো রানার জ্ঞান-গরিমার জন্যে ছাড় দেবে না। আরেকটা প্রবল আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কি আছে ওর?
শেপ মাইয়ারের বো-র দ্রুত অবনতি ঘটছে। দেহ সাপের মত গুটিয়ে বাঁ কাঁধ দিয়ে আঘাত করল রানা লিভারে। খুলে ওপরদিকে উঠে গেল ওটা। টান মেরে হ্যাচ খুলল রানা। কিনারা আঁকড়ে ধরে, কাত হয়ে শরীর গলিয়ে দিল, বাঁ হাত বোসান্‌স্‌ লকারের ভেতরকার লিভার খুঁজছে। সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে, ধাতব লিভারটা হাতে পেয়ে গেল। দুম করে পেছনে লেগে গেল হ্যাচ। রানা গর্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে মাথার ওপরে ডেকে, আছড়ে পড়ল পানি। হ্যাচের মাঝখানের খুব কাছে রয়েছে ওর হাত। পেছনে সরে এসে, কসরৎ করে শরীর মোচড়াল রানা, লিভারের ওপর সজোরে পড়ল ডান হাত। কিনারা গলে চুইয়ে ঢুকল পানি, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেল ফাঁক। ইস্পাতের হ্যাচে বাড়ি খেল ওর মাথা। আগুন ধরে গেল যেন খুলির ভেতর, গুঙিয়ে উঠল রানা। মাথার ভেতর ঝলসে উঠল একাধিক উজ্জ্বল বাতি। হাঁটু ভেঙে স্টীল ডেকে পেতে রাখা ক্যানভাসের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ও। দুলে উঠল গোটা দুনিয়া-জাহাজের গতির সঙ্গে তাল রেখে নাকি নতুন আঘাতটার কারণে, জানে না রানা। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে মাথা।
সামুদ্রিক ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে চলেছে শেপ মাইয়ার।



••• আমাদের কাছে গল্প লিখে পাঠাতে এখানে ক্লিক করুন •••

মোট পৃষ্ঠাদর্শন